টোকিও অলিম্পিক গেমস শুরু হয়েছে। করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে হবে কি হবে না, এ নিয়ে বছরভর অনিশ্চয়তার পর শুক্রবার শেষ পর্যন্ত তা শুরু হয়েছে। কিন্তু অতীতের যেকোনো অলিম্পিক বা যেকোনো ক্রীড়া প্রতিযোগিতার চেয়ে এবারে জাপানের এই অলিম্পিক বিভিন্ন দিক থেকে অনেক আলাদা।
মহামারীর কারণে অলিম্পিকস এক বছর পিছিয়েছে। ফলে ২০৭টি দেশের ১১ হাজার ৩০০ অ্যাথলেট প্রশিক্ষণ ও অনুশীলনের জন্য বাড়তি এক বছর সময় পেয়েছেন। ২০২০ সালের মার্চে যখন টোকিও অলিম্পিকস স্থগিত করার ঘোষণা আসে, আয়োজকরা বলেছিলেন, ‘অলিম্পিক মশাল হবে অন্ধকার সুড়ঙ্গের শেষে আশার আলো।‘ রূপক অর্থে যে সুড়ঙ্গের কথা তারা তখন বলেছিলেন সেই মহামারীর শেষও হয়নি। আলোর দেখা এখনো মেলেনি।
উদ্বোধনের দু’দিন আগে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির প্রেসিডেন্ট টমাস বাখ বলেছেন, স্টেডিয়ামে ঢোকার মুহূর্তটি আনন্দের ও হাফ ছেড়ে বাঁচার মতো একটা অনুভূতি হবে। বিশেষ করে অ্যাথলেটদের জন্য এটি হবে সত্যিই একটি আনন্দের মুহূর্ত। কারণ আমি জানি এই সময়ের জন্য তারা কতটা আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন।
তবে মুখে মাস্ক থাকায় উদ্বোধনীতে মার্চ পাস্টের সময় অ্যাথলেটদের মুখে সেই আনন্দ-উচ্ছ্বাসের প্রতিফলন ততটা বোঝা যায়নি।
মাস্ক, কোয়ারেন্টিন, লালা পরীক্ষা আর ফাঁকা গ্যালারি
কোনো সন্দেহ নেই এই অলিম্পিকস অতীতের যেকোনো গেমসের থেকে ভিন্ন। রাজধানী টোকিওতে এখন কোভিড জরুরি অবস্থা চলছে। গত এক সপ্তাহ ধরে গড়ে প্রতিদিন এক হাজার নতুন কোভিড রোগী শনাক্ত হচ্ছে টোকিওতে।
এর ভেতর সারা পৃথিবী থেকে হাজার হাজার মানুষ তাদের শহরে এসে ভিড় করবে– এটা জাপানের রাজধানীর বহু বাসিন্দা মেনে নিতে পারছেন না। তারা অলিম্পিক বাতিল বা অন্তত স্থগিত করার দাবি করছেন বেশ কিছুদিন ধরে। তবে আয়োজকরা ভরসা দিচ্ছেন বিপদ এড়াতে তারা সর্বোচ্চ সাবধানতা নিচ্ছেন।
অ্যাথলেট ও তাদের সাথে আসা প্রশিক্ষক বা কর্মকর্তাদের ওপরও বিভিন্ন ধরনের বিধিনিষেধ রয়েছে। খাওয়ার সময়, অনুশীলনের সময়, ঘুমানোর সময় বা মূল প্রতিযোগিতার সময় ছাড়া তাদের সবাইকে সবসময় মাস্ক পরে থাকতে হবে। একজনের কাছ থেকে অন্য জনকে যতটা সম্ভব দূরত্ব রাখতে হচ্ছে। আর প্রত্যেককে প্রতিদিন কোভিড পরীক্ষা করতে হচ্ছে। এত কিছুর পরও অলিম্পিককে নিশ্ছিদ্র করা সম্ভব হয়নি। খেলা শুরুর আগেই গেমসে ভাইরাস ঢুকে পড়েছে। শুক্রবার আরো নতুন ১৬ জন কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত অলিম্পিক সংশ্লিষ্ট ১০৬ জন কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন। এদের মধ্যে টোকিওতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন ১১ জন অ্যাথলেট।
ব্রিটেনের ছয়জন অ্যাথলেটকে কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে। কারণ যে বিমানে তারা টোকিওতে যান তার একজন যাত্রী কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার পর তাদেরকে ঘরের বাইরে বেরুতে নিষেধ করা হয়েছে। ব্রিটেনের তিনজন নামকরা অ্যাথলেট – ড্যান ইভান্স, জোয়ানা কন্টা ও বিশ্বের এক নম্বর শ্যুটার অ্যাম্বার হিল- একই কারণে টোকিওতে যাচ্ছেন না।
কোভিড পরীক্ষায় পজিটিভ হওয়ায় মার্কিন টেনিস খেলোয়াড় কোকো গফ গেমস থেকে নিজেকের প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।
এবারে নতুন কী
তবে অলিম্পিকের পরিধিতে কোনো আপস করা হচ্ছে না। বরং নতুন কিছু খেলার ইভেন্ট এবার যোগ হয়েছে। ৩৩টি ভিন্ন খেলায় রেকর্ড ৩৩৯টি মেডেল ইভেন্ট হবে। পাঁচটি নতুন খেলা ও ৩৪টি নতুন ইভেন্ট এই অলিম্পিকে যোগ হয়েছে। নতুন এই পাঁচটি খেলা হচ্ছে – কারাতে, স্কেট-বোর্ডিং, ক্লাইম্বিং, বেসবল-সফট-বল ও সার্ফিং। বেসবল ও সফট-বল সেই অর্থে একদম নতুন নয়। তবে ২০০৮ সালে বেইজিং গেমসের পর এটি আর হয়নি।
বক্সিং, সাইক্লিং, রোয়িং বা নৌকা বাইচ ও সাঁতারে বেশ কিছু নতুন ইভেন্ট যোগ হয়েছে। একইসাথে কিছু ইভেন্টে এবার নারী-পুরুষ একসাথে প্রতিযোগিতা করবে। যেমন ৪০০ মিটার মিশ্র রিলে সাঁতার ও মিশ্র ট্রায়াথলন।
আইওসি বলছে, নতুন প্রজন্মের দর্শক টানতে নতুন কিছু ইভেন্ট ও নারী-পুরুষের মিশ্র ইভেন্ট যোগ করা হয়েছে। সংস্থার প্রধান বলেন, তাদের এই সিদ্ধান্তে খেলাধুলোয় নগরায়নের প্রভাব প্রতিফলিত হয়েছে। বাখ বলেন, নতুন প্রজন্মের সামনে এখন এত সব বিকল্প যে আমরা আর আশা করতে পারিনা যে তারা এমনিতেই অলিম্পিক দেখতে আগ্রহী হবে। অমাদেরকে এখন তাদের কাছে যেতে হবে। আর প্রতিযোগীদের ৪৮.৮ ভাগ নারী, যা একটি রেকর্ড।
বাতিল মোবাইল দিয়ে মেডেল
এবারের অলিম্পিকে পরিবেশ নিয়ে সচেতনতার প্রতিফলন ঘটানোর চেষ্টা হয়েছে।
যেমন, মেডেল তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে নষ্ট ও বাতিল মোবাইল ফোন। অলিম্পিক মশাল তৈরি হয়েছে ২০১১ সালে জাপানে ভূমিকম্পের পর অস্থায়ী বাসস্থানের নির্মাণ কাজের পর ফেলে দেওয়া টুকরো আ্যালুমিনিয়াম দিয়ে। টোকিও অলিম্পিক আয়োজনে যে বিদ্যুৎ ব্যবহার হবে তা উৎপাদিত হচ্ছে নবায়নযোগ্য জ্বালানি পুড়িয়ে।
অলিম্পিক আয়োজনে খরচ হচ্ছে প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার। যদিও খরচ ২২ ভাগ বেড়েছে এক বছর দেরি করার জন্য।
যেসব বিশ্ব তারকার দিকে নজর
আমেরিকান জিমন্যাস্ট সিমোন বাইলস পাঁচ বছর আগে রিও অলিম্পিকসে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। ২৪-বছরের এই নারী প্রথমবার প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে চারটি সোনা ও একটি ব্রোঞ্জ জেতেন। তিনি টোকিওতে পাঁচটি ইভেন্টেই আবারো অংশ নেবেন তিনি।
দু’জন আমেরিকান সাঁতারু প্রাধান্য বজায় রাখবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। ক্যালেব ড্রেসেলের ব্যাগে এখন পর্যন্ত দুটো স্বর্ণপদক জমা হলেও, ২৪-বছরের এই সাঁতারু টোকিওতে ছ’টি জিতবেন বলে আশা করছে যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে রিওতে চারটি সোনা জেতা কেটি লেডেকি ছ’টি ইভেন্টে প্রতিযোগিতা করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সার্বিয়ান টেনিস তারকা নোভাক জোকোভিচ এবছর অস্ট্রেলিয়ান ওপেন, ফ্রেঞ্চ ওপেন এবং উইম্বলডন শিরোপা জিতেছেন। ইউএস ওপেন ও অলিম্পিক জিতে তিনি গোল্ডেন গ্র্যান্ড স্ল্যামের মত বিরল সম্মান অর্জনের চেষ্টা করবেন।
ট্র্যাক সাইক্লিস্ট দম্পতি জেসন এবং ল্যরা কেনি ব্রিটেনের এবারের অলিম্পিক দলের সবচেয়ে বড় দুই তারকা। জেসনের ঝুলিতে এখনই ছ’টি স্বর্ণপদক। অন্যদিকে চারটি সোনা জেতা ল্যরা এখন পর্যন্ত ব্রিটেনের সবচেয়ে সফল নারী অলিম্পিয়ান নজর থাকবে এই দম্পতির দিকে। মাত্র ১৩-বছর বয়সী ব্রিটিশ স্কেটার স্কাই ব্রাউনও টোকিওতে নজর কাড়বেন।